৫.
‘আবুলি রাস্তা’র কথা যেহেতু বলা হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভারে’র কথা বলা না হলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, যুদ্ধের মাইন ফিল্ড থেকে এটি কোনো অংশে কম নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ড্রাইভাররা, তারা যেভাবে গাড়ি চালায় (কিংবা মালিকদের চাপে যেভাবে চালাতে বাধ্য হয়), সেটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক ধরনের মায়া আছে, তা না হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আরও অসংখ্য মানুষ মারা যেত। আমাদের জিডিপি ৬ নাকি ৭—এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে অথচ কেউ খেয়াল করে না যে সড়ক দুর্ঘটনায় কারণে আমাদের দেশে জিডিপির ১ থেকে ২ অংশের অপচয় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু সেটি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, দেখে খুব কষ্ট হয়। হঠাৎ করে যখন সবার খুব প্রিয়জন যিনি একই সঙ্গে দেশের সম্পদ, একটি অর্থহীন গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, তখন সারা দেশে সেটা নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। সেই সময় যখন আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার নায়ক ড্রাইভারদের আরও সহিংস হতে উৎসাহ দিয়ে কথাবার্তা বলেন, তখন সেগুলো এই দেশের সব মানুষের একেবারে স্নায়ুতে গিয়ে কামড়ে ধরে। শাজাহান খানের দেওয়া উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোনো ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে রাস্তায় গাড়ি চালায়, তাদের নতুন নামকরণ হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভার’। ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ আওয়ামী লীগের কতগুলো ভোটকে নষ্ট করে সেই হিসাবটা কেউ কি করছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে স্টক মার্কেট। আমি আগেই বলে রাখি স্টক মার্কেট কীভাবে কাজ করে, আমি সেটা জানি না। চেষ্টা করলে বিষয়টা যে বুঝতে পারব না তা নয়, কিন্তু আমার বোঝার কোনো আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে টাকা-পয়সা রোজগার করে সংসার চালাতে হয় এবং সে জন্য পরিশ্রম করতে হয়। কোনো পরিশ্রম না করে শুধু টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করে কেউ যদি টাকা উপার্জন করে তখন আমার কাছে মনে হয় এর মাঝে কিছু একটা গোলমাল আছে। যেহেতু সারা পৃথিবীই এই গোলমালকে মেনে নিয়ে চলছে, কাজেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি সমস্যাটা পৃথিবীর নয়, সমস্যাটা আমার।
এই স্টক মার্কেটে টাকা ঢেলে এই দেশের অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষ এবং যারা তাদের সর্বস্বান্ত করেছে, তারা এই দেশের বড় বড় রাঘববোয়াল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে, দেশের বিশ্বাসযোগ্য মানুষেরা তদন্ত করে রাঘববোয়ালদের চিনিয়ে দিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি! রাঘববোয়ালরা আরও বড় রাঘববোয়াল হয়েছেন। ভবিষ্যতে আবার সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য শুধু একটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এরা সবাই ভোটার।
এই দেশের মানুষের জন্য একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও যেকোনো বিষয়ের মূল অংশটুকু বুঝে ফেলা যায়, কাজেই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে যখন ভারতবর্ষ আমাদের নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটুকু পেয়ে যাবে, সেটা এই দেশের জন্য সুখবর হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এই সরকারের কথাবার্তা এত নরম সুরের যে শেষ পর্যন্ত রাশেদ খান মেনন বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা যেন আমাদের নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।’ অনেক দুঃখে বলা কথা কিন্তু এই কথার মাঝে যে অনেকখানি সত্যতা আছে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ইনিয়ে-বিনিয়ে এই দেশের পাবলিককে টিপাইমুখ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। পরিষ্কার করে তাদের বুঝতে হবে, এই দেশের পাবলিক টিপাইমুখ খাবে না। বাঁধ দেওয়ার পর পানির পরিবর্তে শরবত এলেও খাবে না, কাজেই তাদের আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে!
নেতিবাচক কথা বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না, আমি এতক্ষণ এতগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে লিখতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এবার শুধু শেষ একটি বিষয় ক্ষান্ত দিই। সেই বিষয়টা হচ্ছে ছাত্রলীগ। একেবারে ভেতর থেকে দেখে আমি আবিষ্কার করেছি ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর হচ্ছে শিক্ষক-রাজনীতি। যেসব ধুরন্ধর শিক্ষক এই রাজনীতি করেন, তাঁরা সব সময় ছাত্রদের ব্যবহার করেন এবং মজার ব্যাপার হলো, খবরের কাগজে ছাত্রদের মাস্তানির খবরটাই আসে, শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের খবরটা আসে না। যখনই ছাত্রলীগের দুই দল কিংবা উপদল (কিংবা উপ-উপদল!) মারামারি করে তখন খবরের কাগজে সেই খবরটা অনেক বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়, সেখানে অবধারিতভাবে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ছবি থাকে। সাধারণ মানুষদের এই ছবিগুলো ভয়ংকরভাবে ধাক্কা দেয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই তাদের মাঝে এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশাল একটি অর্জন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রলীগের একজন কর্মীর তুচ্ছ একটা ঘটনার কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। এই সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে, যেহেতু অনেক বড় কাজ ছোট একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, তাই এগুলোকে যেভাবে সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। "‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধ’ু স্লোগান দিয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা কোনো একটা অঘটন ঘটায়, তখন তারা যে বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর কত বড় অসম্মান করে, সেটা কি তারা জানে?
তবে ইদানীং আমি আরও একটি বিষয় লক্ষ করতে শুরু করেছি, ছাত্ররাজনীতি বলতেই দলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি করা, একরোখা অসহিষ্ণু অস্ত্র হাতে মাস্তানদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেটাই কিন্তু পুরো চিত্র নয়। তার বাইরেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা কোনো রকম স্বার্থের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে আসেনি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক, তারা সত্যি সত্যি একটা আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তাদের দেশের জন্য গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির জগৎটা যেহেতু ঘোলাটে এবং কলুষিত, তাই যারা এই ছাত্রদের ব্যবহার করতে চায় তারাই শুধু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, অন্যরা তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। এই ছাত্রগুলোর কেউ কেউ যেহেতু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে, তাই আমি জানি তাদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ আর অভিমানও আছে। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, সম্ভবত বিষয়টা আমাদের আরও একটু মমতা দিয়ে দেখা উচিত। এ কথাটি সত্যি, একজন আরেকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে খুন করে ফেলতে পারে, এ রকম ছাত্র সত্যিই আছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সেনাবাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে তো এই ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে না দেখে তাদের আদর্শিক দিকগুলো আরও একটু আন্তরিকভাবে দেখলে শেষ পর্যন্ত আমরাই কি লাভবান হব না? নেতৃত্ব খুব রহস্যময় একটা ব্যাপার, যারা ভবিষ্যতের নেতা হবে আমরা কি এখন তাদের একটু সাহায্য করব না?
যারা আওয়ামী লীগ করেন তাঁরা সম্ভবত এই লেখাটি পড়ে আমার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হবেন, তারা মনে করবেন এত কিছু করার পরও আমি তাদের সম্পর্কে বলার মতো একটা ভালো কিছু খুঁজে পেলাম না। বিষয়টি মোটেও সে রকম কিছু নয়, আমি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে তুলনা করার জন্য লেখাটি লিখছি না। আমি যেহেতু মনে করি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপি বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে, তাই আমি আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দিচ্ছি দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটি দেশ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার পুরো দায়িত্ব এখন তাদের। যদি তারা সত্যি সত্যি এই দেশকে ভালোবাসে, তাহলে তাদের কোনো ভুল করার অধিকার নেই। কী কী ভুল করা হতে পারে আমি শুধু আমার মতো করে সেগুলো মনে করিয়ে দিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যদি এই দেশের মানুষকে নতুন জীবনের একটি স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনে জিতে আসে, তাহলে আমাদের কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা যদি এই দেশের মানুষকে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে না পারে, শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলগুলোর জন্য দেশের মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তাদের ক্ষমতায় ডেকে আনে, তাহলে সেটা খুব দুঃখের একটা ব্যাপার হবে। যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বের হয়ে আসবে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাজাকারেরা ঘুরে বেড়াবে, নতুন বাংলা ভাইদের জন্ম হবে—চিন্তা করেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।
যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাটি দিয়েই শেষ করি। আমার এই লেখাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানে যা লেখা হয়েছে সেগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা সব সময় সঠিক হয়, আমি সেটা কখনো দাবি করি না।
তবে লেখাটি পড়ে কেউ যদি মনে করে আমি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার মাঝে আছি, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আমি মোটেও হতাশ নই। দেশকে নিয়ে আমি অসম্ভব আশাবাদী। আমাদের চারপাশে মন খারাপ করার মতো অনেক কিছু ঘটছে, হরতাল, খুনোখুনি, গুম, ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক কোন্দল, কিন্তু এই সবকিছুর মাঝখানে থেকেও কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। লেখাপড়ার মাঝে একটা বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ যেটা পারেনি আমরা সেটা পেরেছি, মেয়েদের ছেলেদের পাশাপাশি সমান সমান জায়গায় নিয়ে এসেছি।
এইটুকুন একটা দেশে এতগুলো মানুষ, তার পরও এই দেশ চাল রপ্তানির কথা ভাবছে। দেশে এত দিন শুধু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল, এখন তেলও খুঁজে পাওয়া গেছে, তার চেয়ে বড় কথা সেই তেল খুঁজে পেয়েছে এই দেশের প্রযুক্তিবিদেরা। বিদ্যুতের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারলে আমার আর কিছু চাওয়া নেই। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরের দেশগুলো শুধু মন খারাপ করা কথা বলত, এখন হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু বলতে হলে তাদের ভালো ভালো কথা বলতেই হয়, সম্ভাবনার কথা বলতেই হয়!
আমি খুব আশাবাদী। বাইরের পৃথিবী বলছে সে জন্য নয়, এই দেশে বসে থেকে আমি অনুভব করতে পারি সে জন্য। (শেষ)
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
‘আবুলি রাস্তা’র কথা যেহেতু বলা হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভারে’র কথা বলা না হলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, যুদ্ধের মাইন ফিল্ড থেকে এটি কোনো অংশে কম নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ড্রাইভাররা, তারা যেভাবে গাড়ি চালায় (কিংবা মালিকদের চাপে যেভাবে চালাতে বাধ্য হয়), সেটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক ধরনের মায়া আছে, তা না হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আরও অসংখ্য মানুষ মারা যেত। আমাদের জিডিপি ৬ নাকি ৭—এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে অথচ কেউ খেয়াল করে না যে সড়ক দুর্ঘটনায় কারণে আমাদের দেশে জিডিপির ১ থেকে ২ অংশের অপচয় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু সেটি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, দেখে খুব কষ্ট হয়। হঠাৎ করে যখন সবার খুব প্রিয়জন যিনি একই সঙ্গে দেশের সম্পদ, একটি অর্থহীন গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান, তখন সারা দেশে সেটা নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। সেই সময় যখন আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার নায়ক ড্রাইভারদের আরও সহিংস হতে উৎসাহ দিয়ে কথাবার্তা বলেন, তখন সেগুলো এই দেশের সব মানুষের একেবারে স্নায়ুতে গিয়ে কামড়ে ধরে। শাজাহান খানের দেওয়া উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোনো ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে রাস্তায় গাড়ি চালায়, তাদের নতুন নামকরণ হয়েছে ‘শাজাহানি ড্রাইভার’। ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ আওয়ামী লীগের কতগুলো ভোটকে নষ্ট করে সেই হিসাবটা কেউ কি করছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে স্টক মার্কেট। আমি আগেই বলে রাখি স্টক মার্কেট কীভাবে কাজ করে, আমি সেটা জানি না। চেষ্টা করলে বিষয়টা যে বুঝতে পারব না তা নয়, কিন্তু আমার বোঝার কোনো আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে টাকা-পয়সা রোজগার করে সংসার চালাতে হয় এবং সে জন্য পরিশ্রম করতে হয়। কোনো পরিশ্রম না করে শুধু টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করে কেউ যদি টাকা উপার্জন করে তখন আমার কাছে মনে হয় এর মাঝে কিছু একটা গোলমাল আছে। যেহেতু সারা পৃথিবীই এই গোলমালকে মেনে নিয়ে চলছে, কাজেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি সমস্যাটা পৃথিবীর নয়, সমস্যাটা আমার।
এই স্টক মার্কেটে টাকা ঢেলে এই দেশের অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, তারা সাধারণ মানুষ এবং যারা তাদের সর্বস্বান্ত করেছে, তারা এই দেশের বড় বড় রাঘববোয়াল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে, দেশের বিশ্বাসযোগ্য মানুষেরা তদন্ত করে রাঘববোয়ালদের চিনিয়ে দিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি! রাঘববোয়ালরা আরও বড় রাঘববোয়াল হয়েছেন। ভবিষ্যতে আবার সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য শুধু একটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এরা সবাই ভোটার।
এই দেশের মানুষের জন্য একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও যেকোনো বিষয়ের মূল অংশটুকু বুঝে ফেলা যায়, কাজেই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে যখন ভারতবর্ষ আমাদের নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটুকু পেয়ে যাবে, সেটা এই দেশের জন্য সুখবর হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এই সরকারের কথাবার্তা এত নরম সুরের যে শেষ পর্যন্ত রাশেদ খান মেনন বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা যেন আমাদের নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা।’ অনেক দুঃখে বলা কথা কিন্তু এই কথার মাঝে যে অনেকখানি সত্যতা আছে, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ইনিয়ে-বিনিয়ে এই দেশের পাবলিককে টিপাইমুখ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। পরিষ্কার করে তাদের বুঝতে হবে, এই দেশের পাবলিক টিপাইমুখ খাবে না। বাঁধ দেওয়ার পর পানির পরিবর্তে শরবত এলেও খাবে না, কাজেই তাদের আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে!
নেতিবাচক কথা বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না, আমি এতক্ষণ এতগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে লিখতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এবার শুধু শেষ একটি বিষয় ক্ষান্ত দিই। সেই বিষয়টা হচ্ছে ছাত্রলীগ। একেবারে ভেতর থেকে দেখে আমি আবিষ্কার করেছি ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেক বেশি ভয়ংকর হচ্ছে শিক্ষক-রাজনীতি। যেসব ধুরন্ধর শিক্ষক এই রাজনীতি করেন, তাঁরা সব সময় ছাত্রদের ব্যবহার করেন এবং মজার ব্যাপার হলো, খবরের কাগজে ছাত্রদের মাস্তানির খবরটাই আসে, শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের খবরটা আসে না। যখনই ছাত্রলীগের দুই দল কিংবা উপদল (কিংবা উপ-উপদল!) মারামারি করে তখন খবরের কাগজে সেই খবরটা অনেক বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়, সেখানে অবধারিতভাবে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ছবি থাকে। সাধারণ মানুষদের এই ছবিগুলো ভয়ংকরভাবে ধাক্কা দেয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই তাদের মাঝে এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশাল একটি অর্জন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রলীগের একজন কর্মীর তুচ্ছ একটা ঘটনার কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। এই সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে, যেহেতু অনেক বড় কাজ ছোট একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, তাই এগুলোকে যেভাবে সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। "‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধ’ু স্লোগান দিয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা কোনো একটা অঘটন ঘটায়, তখন তারা যে বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর কত বড় অসম্মান করে, সেটা কি তারা জানে?
তবে ইদানীং আমি আরও একটি বিষয় লক্ষ করতে শুরু করেছি, ছাত্ররাজনীতি বলতেই দলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি করা, একরোখা অসহিষ্ণু অস্ত্র হাতে মাস্তানদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেটাই কিন্তু পুরো চিত্র নয়। তার বাইরেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা কোনো রকম স্বার্থের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে আসেনি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক, তারা সত্যি সত্যি একটা আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তাদের দেশের জন্য গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির জগৎটা যেহেতু ঘোলাটে এবং কলুষিত, তাই যারা এই ছাত্রদের ব্যবহার করতে চায় তারাই শুধু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, অন্যরা তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। এই ছাত্রগুলোর কেউ কেউ যেহেতু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে, তাই আমি জানি তাদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ আর অভিমানও আছে। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, সম্ভবত বিষয়টা আমাদের আরও একটু মমতা দিয়ে দেখা উচিত। এ কথাটি সত্যি, একজন আরেকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে খুন করে ফেলতে পারে, এ রকম ছাত্র সত্যিই আছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সেনাবাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে তো এই ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে না দেখে তাদের আদর্শিক দিকগুলো আরও একটু আন্তরিকভাবে দেখলে শেষ পর্যন্ত আমরাই কি লাভবান হব না? নেতৃত্ব খুব রহস্যময় একটা ব্যাপার, যারা ভবিষ্যতের নেতা হবে আমরা কি এখন তাদের একটু সাহায্য করব না?
যারা আওয়ামী লীগ করেন তাঁরা সম্ভবত এই লেখাটি পড়ে আমার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হবেন, তারা মনে করবেন এত কিছু করার পরও আমি তাদের সম্পর্কে বলার মতো একটা ভালো কিছু খুঁজে পেলাম না। বিষয়টি মোটেও সে রকম কিছু নয়, আমি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে তুলনা করার জন্য লেখাটি লিখছি না। আমি যেহেতু মনে করি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপি বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে, তাই আমি আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দিচ্ছি দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটি দেশ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার পুরো দায়িত্ব এখন তাদের। যদি তারা সত্যি সত্যি এই দেশকে ভালোবাসে, তাহলে তাদের কোনো ভুল করার অধিকার নেই। কী কী ভুল করা হতে পারে আমি শুধু আমার মতো করে সেগুলো মনে করিয়ে দিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যদি এই দেশের মানুষকে নতুন জীবনের একটি স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনে জিতে আসে, তাহলে আমাদের কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা যদি এই দেশের মানুষকে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে না পারে, শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলগুলোর জন্য দেশের মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তাদের ক্ষমতায় ডেকে আনে, তাহলে সেটা খুব দুঃখের একটা ব্যাপার হবে। যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বের হয়ে আসবে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাজাকারেরা ঘুরে বেড়াবে, নতুন বাংলা ভাইদের জন্ম হবে—চিন্তা করেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।
যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাটি দিয়েই শেষ করি। আমার এই লেখাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানে যা লেখা হয়েছে সেগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা সব সময় সঠিক হয়, আমি সেটা কখনো দাবি করি না।
তবে লেখাটি পড়ে কেউ যদি মনে করে আমি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার মাঝে আছি, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আমি মোটেও হতাশ নই। দেশকে নিয়ে আমি অসম্ভব আশাবাদী। আমাদের চারপাশে মন খারাপ করার মতো অনেক কিছু ঘটছে, হরতাল, খুনোখুনি, গুম, ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক কোন্দল, কিন্তু এই সবকিছুর মাঝখানে থেকেও কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। লেখাপড়ার মাঝে একটা বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ যেটা পারেনি আমরা সেটা পেরেছি, মেয়েদের ছেলেদের পাশাপাশি সমান সমান জায়গায় নিয়ে এসেছি।
এইটুকুন একটা দেশে এতগুলো মানুষ, তার পরও এই দেশ চাল রপ্তানির কথা ভাবছে। দেশে এত দিন শুধু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল, এখন তেলও খুঁজে পাওয়া গেছে, তার চেয়ে বড় কথা সেই তেল খুঁজে পেয়েছে এই দেশের প্রযুক্তিবিদেরা। বিদ্যুতের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারলে আমার আর কিছু চাওয়া নেই। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরের দেশগুলো শুধু মন খারাপ করা কথা বলত, এখন হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু বলতে হলে তাদের ভালো ভালো কথা বলতেই হয়, সম্ভাবনার কথা বলতেই হয়!
আমি খুব আশাবাদী। বাইরের পৃথিবী বলছে সে জন্য নয়, এই দেশে বসে থেকে আমি অনুভব করতে পারি সে জন্য। (শেষ)
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।