শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

রাজনীতি নিয়ে ভাবনা


মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গিয়েছে, যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে এখন তাদের মুখে চুন-কালি লাগানোর অবস্থা। সরকার যদিও ভাঙা রেকর্ডের মতো 'কোনো দুর্নীতি হয়নি' বলে যাচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আসল সত্যটি বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। মন্ত্রী মহোদয়েরও কোনো সমস্যা হয়নি, তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এই বিষয়টা থেমে যাওয়ার আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাটক মঞ্চস্থ হলো। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, মন্ত্রী মহোদয়ের কোনো দোষ নেই,
কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এই রিপোর্টটিকে বিশ্বাস করে?


আমাদের ইতিহাসটুকু হচ্ছে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস, তাই নতুন প্রজন্ম কিন্তু বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক আর যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাস_ তাই নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে জামায়াত-শিবিরকে ঘৃণা করে। বিএনপি যখন সেই জামায়াত-শিবিরকে আলিঙ্গন করে, নতুন প্রজন্মের কাছে সেটি কখনোই কিন্তু গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি নিশ্চিত, বিএনপির ভেতরেও অসংখ্য নেতাকর্মী রয়েছেন যারা কোনোদিন
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটটুকু কখনও মেনে
নেননি, মেনে নেওয়া সম্ভব নয়



আমার এই লেখাটি কারোই খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, কারণ যে বিষয় নিয়ে লিখছি আমি তার বিশেষজ্ঞ নই। প্রশ্ন উঠতেই পারে_ তাহলে আমি লিখছি কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরও আমি একটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি : সবকিছুই কি বিশেষজ্ঞদের চোখে দেখতে হয়? একটা গুরুতর বিষয় সাধারণ মানুষ কেমন করে দেখে, সেটাও কি অন্যদের জানার কৌতূহল হওয়া উচিত না?
আমার ভণিতা দেখে সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করে ফেলেছেন, আমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে (শুদ্ধ করে বলা উচিত চৌদ্দ দল; কিন্তু আগেই বলেছি লেখাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানে অনেক ভুলভাল থাকবে!), দেশটা কেমন চলছে সেটা নিয়ে সবারই নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। আমারও আছে। আমাদের দেশের এত রকম সমস্যা তার সবকিছু ম্যানেজ করে কোনো সরকার পাঁচ বছর টিকে থাকতে পারলেই আমি তাকে পাস মার্ক দিয়ে দিই। টিকে থাকার সঙ্গে সঙ্গে যদি সরকার শিক্ষার ব্যাপারটা দেখে তাহলেই আমি তাকে এ-প্লাস দিতে রাজি আছি (তার কারণ এই পৃথিবীতে যতগুলো দেশ তাদের সমস্যা মিটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে তার সবাই সেটা করেছে শুধু শিক্ষাটাকে ব্যবহার করে)। আমি মনে মনে খুব আশা করে ছিলাম, এই সরকার শিক্ষার জন্য আরও টাকা-পয়সা খরচ করবে, করল না! বাংলাদেশের শিক্ষার পেছনে খরচ করার কথা জিডিপির ছয় ভাগ_ এই সরকার খরচ করে মাত্র ২.৪ ভাগ। পৃথিবীর আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পেছনে এত কম টাকা খরচ করে বলে আমার জানা নেই। সবাই পদ্মা সেতু, ওড়াল সেতু, পরিবেশ_ এসব নিয়ে কথা বলে, কিন্তু যদি শুধু শিক্ষার জন্য আর অল্প কিছু টাকা বেশি খরচ করত তাহলে এ দেশে যে কী ম্যাজিক হয়ে যেত সেটা কেউ বুঝল না_ আহা রে!
তবে আমার দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে আমি এই সরকারকে শুধু এ-প্লাস নয় গোল্ডেন এ-প্লাস দিয়ে দেব, যদি তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা ঠিক ঠিকভাবে করতে পারে। 'ঠিক ঠিকভাবে' বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? বিষয়টা খুবই সহজ, যাদের ধরা হয়েছে আমাদের প্রজন্ম তাদের সবাইকে চিনে, আমাদের চোখের সামনে একাত্তরে তারা সেই ভয়ঙ্কর কাজগুলো করেছে, কাজেই ট্রাইব্যুনাল যদি তাদের দোষী প্রমাণ করে শাস্তি দিতে পারে তাহলে আমরা বলব 'ঠিক ঠিকভাবে' বিচার হয়েছে। যদি দেখা যায়, বিচার কাজে অবহেলার কারণে শেষ পর্যন্ত ফাঁকফোকর দিয়ে এই যুদ্ধাপরাধীগুলো বের হয়ে গেছে তাহলে আমরা বুঝব 'ঠিক ঠিকভাবে' বিচার হয়নি (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা মনে হলেই আমার একজন মানুষের কথা মনে পড়ে। সেক্টর কমান্ডারদের একটা মানববন্ধনে মানুষটি হিংস্রগলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাবাকে তো তারা বিচার করে মারেনি, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাদের কেন বিচার করতে হবে? আমি জানি এই যুক্তি ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া যাবে না; কিন্তু কথাটি আমি কখনও ভুলতে পারি না)।
এ দেশে এখন যতগুলো অসমাপ্ত বিষয় আছে, তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার। একাত্তরের নৃশংসতাটি যে কী ভয়ঙ্কর ছিল নতুন প্রজন্ম সেটি কোনোদিন অনুভব দূরে থাকুক, কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষও সেটি চিন্তাও করতে পারবে না। সেই নৃশংসতায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের বিচার না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের দেশটিই আসলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিচার শেষ করার পর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে আমরা এই গ্গ্নানিময় অধ্যায়টিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব। বারো-তেরো বছরের ছেলেমেয়েরা আর আমাকে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে না, 'রাজাকাররা কেমন করে এই দেশে গাড়িতে ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?' বরং আমি তাদের ডেকে বলব, 'চলি্লশ-বিয়ালি্লশ বছর দেরি হলেও এ দেশের মাটিতে আমরা রাজাকারদের বিচার করেছি। দেশের মাটিটাকে পবিত্র করে ছেড়েছি!' কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার বুকটা কেমন করে ফুলে উঠবে সেটা চিন্তা করেই আমার বুকটা ফুলে উঠছে। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে সেই সুযোগটা দেবে তো?

আমরা সবাই জানি, এ দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী নেই, ইতালিতে ফ্যাসিস্ট বাহিনী নেই, কিন্তু আমাদের দেশে কেমন করে জামায়াতে ইসলামী থেকে গেল? এখন আমরা সবাই জানি, কেন এবং কেমন করে সেটা ঘটেছে, কিন্তু যেটা এখনও আমি বিশ্বাস করতে পারি না সেটা হচ্ছে, সেই জামায়াতে ইসলামীর একটা ছাত্র সংগঠন আছে। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন করে? কম বয়সী তরুণদের দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা, দেশের জন্য লাগামছাড়া ভালোবাসার আবেগে ডুবে যাওয়ার কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহঙ্কার করার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস করার কথা, পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার কথা, ছাবি্বশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে রক্ত গরম করার কথা, ১৬ ডিসেম্বর মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে পথে নেমে যাওয়ার কথা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি করার কথা অথচ সেই বয়সের তরুণরা এসব কিছু না করে কেমন করে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হিসেবে মেনে তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে পারে? দেশকে ভালো না বেসে কেমন করে সেই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন থেকে ঠেলে সরিয়ে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করতে পারে? আমি জানি, আমি কখনোই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব না, কেউ যদি কিছু একটা উত্তর আমাকে দেওয়ার চেষ্টাও করে আমি সেটা বুঝতে পারব না (বেশ কিছুদিন আগে খবরের কাগজে আমি এ রকম একটা কথা আরও একবার লিখেছিলাম, তখন একটা ছাত্র আমাকে এসএমএস করে জানিয়েছিল সে খুব ভালো ছাত্র এবং তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু সে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবির করে, কারণ তার বিভাগীয় প্রধান তাকে বলেছে তা না হলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে না। আমি খোঁজ নিইনি, কাজেই জানি না শেষ পর্যন্ত সে শিক্ষক হতে পেরেছিল কি-না!)।
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে চুরানব্বইয়ের শেষে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম। দেশে তখন বিএনপি সরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোতেও বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের ছেলেরাই বেশি। তাদের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের কথা অনেক বড় করে বলা হয়। একদিন এক অনুষ্ঠানে একজন রাজাকারদের বিদ্রূপ করে বক্তৃতা করেছে। পরের দিন খবর পেলাম, শিবিরের ছেলেরা তার পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। দেশের বাইরে থাকতেই এই পদ্ধতির খবর পেয়েছিলাম। দেশে ফিরে এসে এই প্রথম আমার নিজের চোখে রগ কাটার ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হলো। ছাত্রদলের ছেলেদের ভেতর দেশের জন্য তীব্র ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর মমতা এবং রাজাকারদের জন্য ভয়ঙ্কর ঘৃণা। সেসব নিয়ে শিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের ছাত্রদের প্রতি মুহূর্ত সংঘাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের ভেতরেই আমাকে একটা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো। রাজাকারদের নিয়ে কিছু একটা বলার জন্য শিবিরের একজন ছাত্রদলের একজনের পিঠে চাকু মেরেছে, সেটি নিয়ে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত শেষ করার আগেই শিবিরের ছাত্রটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশ পর্যন্ত ছেড়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছে!
এভাবেই চলছিল, ঠিক তখন নিরানব্বই সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ এবং দুর্ভাগ্যময় ঘটনাটি ঘটে গেল। ভোটের রাজনীতি করার জন্য বিএনপি আর জামায়াত একত্র হয়ে গেল। আমার মনে আছে, ছাত্রদলের তরুণ ছেলেদের মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমার কাছে এসেছিল সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য, শুকনো মুখে তারা আমাকে অনেক কথা বলেছে, আমি তাদের কিছু বলে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। কম বয়সী তরুণ ছাত্ররা যেটা বুঝতে পেরেছিল বিএনপির বড় নেতারা সেটা বুঝতে পারেননি। আমরা সবাই যেটি অনুমান করেছিলাম সেটি ঘটতে শুরু করল নব্বইয়ের দশকের আধুনিক একটা রাজনীতিক দল দেখতে দেখতে জামায়াতে ইসলামী ধাঁচের একটি দল হয়ে গেল। এই দেশের জন্য কত বড় দুর্ভাগ্য! কী দুঃখের কথা!

আমার ধারণা, বিএনপির নেতারা খুব বড় একটা ভুল করেছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিকে খাটো করে দেখছেন_ এ দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মোটেও খাটো একটা বিষয় নয়। এ দেশে অনেক মানুষ আছে যাদের আওয়ামী লীগ নিয়ে অ্যালার্জি আছে, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও অ্যালার্জি আছে! পঁচাত্তর থেকে নব্বই ছিল এ দেশের জন্য অন্ধকার সময়, সেই সময়ে এ দেশের প্রজন্মকে অন্ধকারে রেখে বড় করা হয়েছিল, দেশের ইতিহাস না জানিয়ে তাদের গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই অন্ধকার সময় কিন্তু কেটে গেছে, আবার কিন্তু সেই সময় আর ফিরে আসবে না। এরপর প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, যারা দেশের সত্যিকারের ইতিহাসটুকু জানে। আমাদের ইতিহাসটুকু হচ্ছে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস, তাই নতুন প্রজন্ম কিন্তু বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক আর যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাস_ তাই নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে জামায়াত-শিবিরকে ঘৃণা করে। বিএনপি যখন সেই জামায়াত-শিবিরকে আলিঙ্গন করে, নতুন প্রজন্মের কাছে সেটি কখনোই কিন্তু গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি নিশ্চিত, বিএনপির ভেতরেও অসংখ্য নেতাকর্মী রয়েছেন যারা কোনোদিন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটটুকু কখনও মেনে নেননি, মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
আমার ধারণা, বিএনপির ভেতরের এই নেতাকর্মীরা আগে হোক পরে হোক মাথা তুলে দাঁড়াবে। ভোটের কথা বলে এক সময় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করা হয়েছিল, সেই ভোটের সংখ্যাই যদি কমে যায় তাহলে আদর্শকে কেন শুধু শুধু ছুড়ে ফেলা হবে? বাংলাদেশ এখন এমন একটি জায়গায় পেঁৗছে গেছে যে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে কোনো দল আর এখানে রাজনীতি করতে পারবে না (কেউ কি লক্ষ্য করেছে জামায়াতে ইসলামী ইদানীং স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে?)। কাজেই আমার ধারণা, বিএনপি যদি জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ না করে তা হলে আগে হোক পরে হোক তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বিপক্ষে এই দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, আমার ধারণা বিএনপি দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর যে দলটি জামায়াত-ঘেঁষা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেই দলটি মুসলিম লীগের মতো দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলটি সত্যিকার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে যাবে।
বিএনপির মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দল এই কথাগুলো জানে না সেটি হতে পারে না। তাই আমার কাছে খুব অবাক লাগে, যখন দেখি তারা এ দেশের মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা দেশ নিয়ে তীব্র আবেগটুকু অনুভব করতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি না করে তারা বিচারের বিরুদ্ধে একশ' রকম কুযুক্তি দাঁড়া করাতে চায়। কী আশ্চর্য!

এবারে একটু আওয়ামী লীগের কথা বলি। গত নির্বাচনের ফলাফলের দিনটি ছিল আমাদের মতো মানুষের জন্য খুব আনন্দের একটি দিন। সেদিন এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে, ডিজিটাল বাংলাদেশের পক্ষে_ এক কথায় একটি আধুনিক বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছিল। দেশের মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল (আরও একবার আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের অনেক আশা-ভরসা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে)। বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বপ্ন দেখা সেই দেশ, তাই যখন বাংলাদেশকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ঠিক করে দেওয়া পথ থেকে সরিয়ে অন্য পথে নেওয়ার চেষ্টা করে, তখন দেশটা আর বাংলাদেশ থাকে না। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই স্বপ্ন থেকে সরে এসেছে_ কোনো দল জামায়াতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিলে সেটি আর মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে পারে না। কাজেই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটি এখন পুরোপুরি আওয়ামী লীগের ওপর।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্বটি নিতে রাজি কি-না (আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি 'প্রস্তুত' কি-না_ আমি জিজ্ঞেস করেছি 'রাজি' কি-না!)। আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখছি তাতে মনে হয় তারা সেই দায়িত্বটি নিতে আর আগ্রহী নয়। '৭১ সালে তারা দায়িত্ব নিয়েছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন আর যুদ্ধ করার সুযোগ নেই, এখন দায়িত্ব নিতে হলে ভোট পেতে হবে, ভোট পেতে হলে সম্ভাব্য ভোটারদের খুশি রাখতে হবে। আমরা সবাই দেখছি তারা হিসাব করে যে কাজগুলো করছে সেগুলো হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। কয়েকটা উদাহরণ দিই।
শুরু করতে হবে প্রফেসর ইউনূসকে দিয়ে। প্রফেসর ইউনূস সারা পৃথিবীর মাঝে একজন অত্যন্ত সম্মানী মানুষ। তিনি শুধু যে ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তা নয়, কিছুদিন আগে তাকে স্টিভ জবস, বিল গেটস কিংবা গুগল বা ফেসবুকের প্রবর্তকদের মতো সমান কাতারের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি (আশির দশকেই আমি একটা লেখায় তার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম), কাজেই তার সম্পর্কে আমার লেখায় যুক্তিতর্ক খুঁজে লাভ নেই! কিন্তু প্রফেসর রেহমান সোবহান তার লেখায় লিখেছিলেন, এই মানুষটি সারা পৃথিবীর অল্প কয়েকজন মানুষের ভেতর একজন, যিনি যে কোনো সময় পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে টেলিফোন তুলে কথা বলার অধিকার রাখেন। কাজেই বাংলাদেশের উচিত হবে এই অসাধারণ সুযোগটি দেশের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ সরকার এই সুযোগ গ্রহণ করা তো দূরের কথা_ তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাকে অপমান করার জন্য। হিলারি ক্লিনটন ঘুরে যাওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রফেসর ইউনূস সম্পর্কে যে ভাষায় যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে আতঙ্ক অনুভব করেছি। সম্মানী মানুষ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বললে তার সম্মানের ক্ষতি হয় না, কিন্তু কথাগুলো বলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তার নিজের মানসিক পরিপকস্ফতার যে নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন, সেটা দেখে কি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আতঙ্ক হতে পারে না?
প্রফেসর ইউনূস আসলেই 'রক্তচোষা', 'মহাজন' কি-না আমি সেই কুতর্ক শুরু করতে চাই না_ শুধু বলতে চাই, এ দেশে তার তৈরি করা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রায় এক কোটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয়স্বজন মিলে কয়েক কোটি মানুষ আছে, যাদের সবাই ভোটার। এ দেশের প্রায় সত্তর-আশি লাখ মানুষ বিদেশে থাকেন, তারাও ভোটার (ভোটের সময় তারা আসলে ভোট দিতে পারেন কি-না সেটি অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন)। এ দেশের তরুণরা প্রায় কয়েক কোটি_ তাদের একটা বড় অংশ ভোটার! আমি যে তিনটি দলের মানুষের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকে প্রফেসর ইউনূসকে পছন্দ করেন এবং যখন তাকে অসম্মান করা হয়েছে তারা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছেন। যে দল ভোটের রাজনীতি করে সেই দল একসঙ্গে এত ভোটারকে এত দক্ষতার সঙ্গে অন্য কোনোভাবে বিরক্ত করেছে বলে আমার জানা নেই_ কী কারণে সেটা করেছে তার কারণটা আমি এখনও জানি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনূসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা না করে তাকে যদি তার অফিসে শুধু একবার চা খেতে ডাকতেন তাহলেই এ দেশের কত মানুষের বুকের ভার যে লাঘব হতো সেটা কি তারা জানেন?
বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ আদিবাসী রয়েছে (মতান্তরে ৪০ লাখ)। তবে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে, সরকার হঠাৎ করে একদিন ঠিক করেছে তাদের আর আদিবাসী বলা যাবে না, তাদের উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠী বা এই ধরনের আরও কঠিন এবং অসম্মানজনক কিছু বলতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি এখনও আমার কাছে রহস্য। লোকমুখে শুনেছি, এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একটা চাপ রয়েছে, জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরিতে সেনাবাহিনী যেতে পারবে কি পারবে না_ এই নামকরণের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের মানুষজনের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিরিবিলি কথা বলার চেষ্টা করলে তারা ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক শুরু করে দেন; কিন্তু এতদিন কেন তাহলে তাদের আদিবাসী বলা হলো, হঠাৎ করে কেন আর তাদের আদিবাসী বলা যাবে না_ সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। কোনো একটা কিছু বোঝাতে যখন একটা শব্দ ব্যবহার করা রেওয়াজ হয়ে যায়, তখন সেটাই যে প্রচলিত হয়ে যায় এই সোজা কথাটা কে বোঝাবে? কিছুদিন আগে একটা সরকারি সার্কুলারের অনুলিপি আমার চোখে পড়েছে, যেখানে বলা হয়েছে_ আগস্ট মাসকে শোকের মাস দেখিয়ে আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে যেন সব মহলকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডকে এ রকম কূটকৌশলে একটা হীন কাজে ব্যবহার করা হবে_ সেটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! যাই হোক, যে সরকারকে ভোটে জিতে আসতে হবে তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে, চলি্লশ লাখ আদিবাসীর অন্ততপক্ষে বিশ লাখ ভোটার! এতগুলো ভোটারকে এত অবলীলায় ক্ষুব্ধ করে তোলার উদাহরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে?
একসঙ্গে দেশের অনেক মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলার আরেকটা সহজ উপায় কী হতে পারে? সেটা হচ্ছে, ঈদে যেন মানুষজন তাদের বাড়িতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া। এই সরকারের আমলে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ঈদের আগে আগে দেখা গেল রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ যে, সেই পথে কোনো বাস যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পাই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে নানা ধরনের উড়াল সেতু, ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে। একটি নয় দু'দুটি পদ্মা সেতু তৈরি নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আলোচনা হচ্ছে (তার প্রস্তুতির জন্য নিশ্চয়ই এর মাঝে কয়েকশ' কোটি টাকা খরচ পর্যন্ত হয়ে গেছে); কিন্তু সাধারণ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারছে না_ এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, কাজেই রসিক বাঙালি এখন ভাঙাচোরা বেহাল রাস্তাঘাট বোঝানোর জন্য বলে, 'আবুলী' রাস্তা! ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ যোগ করে আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো একটু সমৃদ্ধ হলো, কিন্তু ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হলো কি? বিষয়টা আরও গুরুতর হয়ে গেল যখন দেখা গেল রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য টাকার বরাদ্দ আছে, কিন্তু সেই টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্য কারও গরজ নেই। কারণটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না_ দেশের ভেতরকার রাস্তাঘাট তৈরিতে পয়সা-কড়ি নেই, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, বড় বড় পদ্মা সেতুতে অনেক টাকা-পয়সা। কাজেই উৎসাহটা সেখানেই বেশি।
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ অনেকদিন থেকে আলোচনার মাঝে রয়েছেন। আমাদের দেশের দুর্নীতির খবর সাধারণত দেশের ভেতরেই থাকে, আমাদের এই মন্ত্রীর কারণে দুর্নীতির খবরটি মোটামুটিভাবে একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দেশের সরকারের সঙ্গে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হচ্ছে, উইকিলিকস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অত্যন্ত অসম্মানজনক বক্তব্য বের হয়ে আসছে, কানাডার কোর্টে মামলা হয়ে রায় বের হচ্ছে, যেখানে মন্ত্রী মহোদয়ের ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে, সব মিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ লেজেগোবরে অবস্থা। পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গিয়েছে, যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে এখন তাদের মুখে চুন-কালি লাগানোর অবস্থা। সরকার যদিও ভাঙা রেকর্ডের মতো 'কোনো দুর্নীতি হয়নি' বলে যাচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আসল সত্যটি বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। মন্ত্রী মহোদয়েরও কোনো সমস্যা হয়নি, তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এই বিষয়টা থেমে যাওয়ার আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাটক মঞ্চস্থ হলো। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে, মন্ত্রী মহোদয়ের কোনো দোষ নেই, কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এই রিপোর্টটিকে বিশ্বাস করে? রাজনৈতিক নেতারা এত কিছু বুঝেন কিন্তু কেন জানি একটা অত্যন্ত সহজ জিনিস বুঝেন না_ আসলে কী ঘটেছে তার থেকে অনেক-অনেক-অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাটি কী। কাগজে-কলমে অনেক কিছু লিখে ফেলা যায়, অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়; কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের ধারণার কোনো পরিবর্তন হয় না। দুর্নীতির ছাপ 'পার্মানেন্ট ইংক'-এর ছাপের মতো, একবার লেগে গেলে শতবার ঘষেও তোলা যায় না। যাদের ওপর এই ছাপ পড়েছে তাদের সরে যাওয়া ছাড়া এর আর কোনো বিকল্প নেই।
'আবুলী' রাস্তার কথা যেহেতু বলা হয়েছে, 'শাজাহানী' ড্রাইভারের কথা বলা না হলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, যুদ্ধের মাইন ফিল্ড থেকে এটি কোনো অংশে কম নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ড্রাইভাররা_ তারা যেভাবে গাড়ি চালায় (কিংবা মালিকদের চাপে যেভাবে চালাতে বাধ্য হয়), সেটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টিকর্তার এক ধরনের মায়া আছে, তা না হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আরও অসংখ্য মানুষ মারা যেত। আমাদের জিডিপি ৬ নাকি ৭_ এ নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে অথচ কেউ খেয়াল করে না যে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আমাদের দেশে জিডিপির ১ থেকে ২ অংশের অপচয় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিন্তু সেটি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, দেখে খুব কষ্ট হয়। হঠাৎ করে যখন সবাই খুব প্রিয়জন যিনি একই সঙ্গে দেশের সম্পদ, একটি অর্থহীন গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, তখন সারাদেশে সেটা নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। সেই সময় যখন আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার নায়ক ড্রাইভারদের আরও সহিংস হতে উৎসাহ দিয়ে কথাবার্তা বলেন, তখন সেগুলো এ দেশের সব মানুষের একেবারে স্নায়ুতে গিয়ে কামড়ে ধরে। শাজাহান খানের দেওয়া উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোনো ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে রাস্তায় গাড়ি চালায়, তাদের নতুন নামকরণ হয়েছে 'শাজাহানী' ড্রাইভার। ডিকশনারিতে একটা নতুন শব্দ আওয়ামী লীগের কতগুলো ভোটকে নষ্ট করে সেই হিসাবটা কেউ কি করছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে স্টক মার্কেট। আমি আগেই বলে রাখি, স্টক মার্কেট কীভাবে কাজ করে সেটা আমি জানি না। চেষ্টা করলে বিষয়টা যে বুঝতে পারব না তা নয়, কিন্তু আমার বোঝার কোনো আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে টাকা-পয়সা রোজগার করে সংসার চালাতে হয় এবং সে জন্য পরিশ্রম করতে হয়। কোনো পরিশ্রম না করে শুধু টাকা-পয়সা নাড়াচাড়া করে কেউ যদি টাকা উপার্জন করে তখন আমার কাছে মনে হয়, এর মাঝে কিছু একটা গোলমাল আছে। যেহেতু সারা পৃথিবীই এই গোলমালকে মেনে নিয়ে চলছে কাজেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, সমস্যাটা পৃথিবীর নয়, সমস্যাটা আমার।
এই স্টক মার্কেটে টাকা ঢেলে এ দেশের অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে তারা সাধারণ মানুষ এবং যারা তাদের সর্বস্বান্ত করেছে তারা এ দেশের বড় বড় রাঘববোয়াল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে, দেশের বিশ্বাসযোগ্য মানুষ তদন্ত করে রাঘববোয়ালদের চিনিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। রাঘববোয়ালরা আরও বড় রাঘববোয়াল হয়েছেন, ভবিষ্যতে আবার সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য শুধু একটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এরা সবাই ভোটার।
এ দেশের মানুষের জন্য একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও যে কোনো বিষয়ের মূল অংশটুকু বুঝে ফেলা যায়। কাজেই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে যখন ভারতবর্ষ আমাদের নদীর পানিতে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটুকু পেয়ে যাবে, সেটা এ দেশের জন্য সুখবর হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এই সরকারের কথাবার্তা এত নরম সুরের যে, শেষ পর্যন্ত রাশেদ খান মেনন বলতে বাধ্য হয়েছেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন আমাদের নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। অনেক দুঃখে বলা কথা কিন্তু এই কথার মাঝে যে অনেকখানি সত্যতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ইনিয়ে-বিনিয়ে এ দেশের পাবলিককে টিপাইমুখ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন_ পরিষ্কার করে তাদের বুঝতে হবে এ দেশের পাবলিক টিপাইমুখ খাবে না। বাঁধ দেওয়ার পর পানির পরিবর্তে শরবত এলেও খাবে না, কাজেই তাদের আরও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে!
নেতিবাচক কথা বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না, আমি এতক্ষণ এতগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে লিখতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এবারে শুধু শেষ একটি বিষয় লিখে ক্ষান্ত দিই। সেই বিষয়টি হচ্ছে ছাত্রলীগ। একেবারে ভেতর থেকে দেখে আমি আবিষ্কার করেছি ছাত্ররাজনীতি থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি। যেসব ধুরন্ধর শিক্ষক এই রাজনীতি করেন তারা সবসময় ছাত্রদের ব্যবহার করেন এবং মজার ব্যাপার হলো, খবরের কাগজে ছাত্রদের মাস্তানির খবরটাই আসে, শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের খবরটা আসে না। যখনই ছাত্রলীগের দুই দল কিংবা উপদল (কিংবা উপ-উপদল!) মারামারি করে, তখন খবরের কাগজে সেই খবরটা অনেক বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো হয়, সেখানে অবধারিতভাবে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ছবি থাকে। সাধারণ মানুষকে এই ছবিগুলো ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা দেয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই তাদের মাঝে এক ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশাল একটি অর্জন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রলীগের একজন কর্মীর তুচ্ছ একটা ঘটনার কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। এই সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে, যেহেতু অনেক বড় বড় কাজ ছোট একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, তাই এগুলোকে যেভাবে সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। 'জয় বাংলা' এবং 'জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান দিয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা কোনো একটা অঘটন ঘটায় তখন তারা যে বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর কত বড় অসম্মান করে সেটা কি তারা জানে?
তবে ইদানীং আমি আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করতে শুরু করেছি। ছাত্ররাজনীতি বলতেই দলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি করা, একরোখা অসহিষ্ণু, অস্ত্র হাতে মাস্তানদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেটাই কিন্তু পুরো চিত্র নয়। তার বাইরেও অনেক ছাত্রছাত্রী আছে যারা কোনো রকম স্বার্থের জন্য ছাত্ররাজনীতিতে আসেনি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সেটা খুবই স্বাভাবিক_ তারা সত্যি সত্যি একটা আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তাদের দেশের জন্য গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির জগৎটা যেহেতু ঘোলাটে এবং কলুষিত, তাই যারা এই ছাত্রদের ব্যবহার করতে চায় তারাই শুধু তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, অন্যরা তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। এই ছাত্রগুলোর কেউ কেউ যেহেতু মাঝে মধ্যে আমার কাছে আসে, তাই আমি জানি তাদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে। শুধু তাই নয় তাদের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ আর অভিমানও আছে। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, সম্ভবত পুরো বিষয়টা আমাদের আরও একটু মমতা দিয়ে দেখা উচিত। এ কথাটি সত্যি, একজন আরেকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে খুন করে ফেলতে পারে_ এ রকম ছাত্র সত্যিই আছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সেনাবাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল তখন তাদের বিরুদ্ধে তো এই ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে না দেখে তাদের আদর্শিক দিকগুলো আরও একটু আন্তরিকভাবে দেখলে শেষ পর্যন্ত আমরাই কি লাভবান হবো না? নেতৃত্ব খুব একটা রহস্যময় ব্যাপার, যারা ভবিষ্যতের নেতা হবে আমরা কি এখন তাদের একটু সাহায্য করব না?
৫.
যারা আওয়ামী লীগ করেন তারা সম্ভবত এই লেখাটি পড়ে আমার ওপর খুব ক্ষুব্ধ হবেন, তারা মনে করবেন এত কিছু করার পরও আমি তাদের সম্পর্কে বলার মতো একটা ভালো কিছু খুঁজে পেলাম না। বিষয়টি মোটেও সে রকম কিছু নয়, আমি আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে তুলনা করার জন্য এই লেখাটি লিখছি না। আমি যেহেতু মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপি বাংলাদেশ নামের এই রাষ্ট্রের পরিচালনায় নৈতিক অধিকার হারিয়েছে, তাই আমি আওয়ামী লীগকে মনে করিয়ে দিচ্ছি দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একটি দেশ হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার পুরো দায়িত্ব এখন তাদের। যদি তারা সত্যি সত্যি এই দেশকে ভালোবাসে তাহলে তাদের কোনো ভুল করার অধিকার নেই। কী কী ভুল করা হতে পারে, আমি শুধু আমার মতো করে সেগুলো মনে করিয়ে দিয়েছি মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী যদি এই দেশের মানুষকে নতুন জীবনের একটি স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনে জিতে আসে তাহলে আমাদের কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু তারা যদি এ দেশের মানুষকে নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে না পারে_ শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের ভুলগুলোর জন্য দেশের মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তাদের ক্ষমতায় ডেকে আনে, তাহলে সেটা খুব দুঃখের একটা ব্যাপার হবে। যুদ্ধাপরাধীরা জেলখানা থেকে বের হয়ে আসবে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাজাকাররা ঘুরে বেড়াবে, নতুন বাংলাভাইয়ের জন্ম হবে_ চিন্তা করেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।
যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথাটি দিয়েই শেষ করি। আমার এই লেখাটি খুব গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানে যা লেখা হয়েছে সেগুলো আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা সবসময় সঠিক হয় আমি সেটা কখনও দাবি করি না।
তবে লেখাটি পড়ে কেউ যদি মনে করে আমি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার মধ্যে আছি, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আমি মোটেও হতাশ নই। দেশকে নিয়ে আমি অসম্ভব আশাবাদী। আমাদের চারপাশে মন খারাপ করার জন্য অনেক কিছু ঘটছে। হরতাল, খুনোখুনি, গুম, ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক কোন্দল_ কিন্তু এসব কিছুর মাঝখানে থেকেও কিন্তু আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। লেখাপড়ার মাঝে একটা বিপ্লব শুরু হতে যাচ্ছে। পৃথিবীতে অন্য অনেক দেশ যেটা পারেনি আমরা সেটা পেরেছি, মেয়েদেরকে ছেলেদের পাশাপাশি সমান সমান জায়গায় নিয়ে এসেছি। এটুকুন একটা দেশে এতগুলো মানুষ তারপরও এ দেশ চাল রফতানির কথা ভাবছে। দেশে এতদিন শুধু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল, এখন তেলও খুঁজে পাওয়া গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সেই তেল খুঁজে পেয়েছে এ দেশের প্রযুক্তিবিদরা! বিদ্যুতের সমস্যাটা মিটিয়ে দিতে পারলে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বাইরের দেশগুলো শুধু মন খারাপ করার কথা বলত, এখন হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু বলতে হলে তাদের ভালো ভালো কথা বলতেই হয়, সম্ভাবনার কথা বলতেই হয়!
আমি খুব আশাবাদী। বাইরের পৃথিবী বলছে সে জন্য নয়, এই দেশে বসে থেকে আমি সেটা অনুভব করতে পারি, সে জন্য!
১৯.৫.১২

লেখাটি মুহম্মদ জাফর ইকবালের ব্যক্তিগত সাইট সাদাসিধে কথা ডট কম (িি.িংধফধংরফযবশড়ঃযধ.পড়স) থেকে নেওয়া

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক ও অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন